হিন্দুত্ববাদের ইতিহাস
হাইস্কুলে থাকতে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট পড়তে গিয়া তাতে রাম নামটা দুইবার পাইছিলাম। প্রথমবার খুব সম্ভবত তাওরাত শরিফে, পরিষ্কার মনে নাই। আরেকবার রামের নামের উল্লেখ পাইছিলাম আইয়ুব নবীর কিতাবে, যাতে আইয়ুবের একজন বন্ধুকে রামের বংশধর বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হইছে। কিন্তু কে ছিলেন ঐ রাম নামক পূর্বপুরুষ, সেই বিষয়ে কোন তথ্য নাই। আন্দাজ করি, তৎকালীন পাঠকদের কাছে তা সাধারণ জ্ঞান ছিল বলেই উল্লেখ করা হয় নাই।
★ হিন্দুত্ববাদের ইতিহাস
তো, রাম নামে কি মধ্যপ্রাচ্যে কখনো ইন্দোইউরোপিয় বা ইন্দোইরানিয় জাতির এক বা একাধিক মানুষ সুপরিচিত ছিলেন? তা বলতে পারবো না। এই ব্যাপারে কখনো খোঁজ নেয়া হয় নাই। তবে, রাম নামে কখনো ইন্দোইরানিয় জাতির কোন লোক মধ্যপ্রাচ্যে সুপরিচিত ছিলেন না, এই দাবি করাও সম্ভব না। কেননা, খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহশ্রাব্দের প্রথম ভাগ থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে ইন্দোইউরোপিয় বিভিন্ন জাতির নগর ও রাজত্ব প্রতিষ্ঠার ইতিহাস পাওয়া যায়। ইনফ্যাক্ট, খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহশ্রাব্দের হিন্দুস্তানে আপনি আর্য তথা ইন্দোইউরোপিয় কোন জাতির বসত বা রাজ্য প্রতিষ্ঠার অমন পরিষ্কার রেকর্ড পাইবেন না। অন্তত, আমার জানা নাই অমন কোন রেকর্ডের কথা।
★হিন্দুত্ববাদের ইতিহাস
ছবির এই ম্যাপটা কয়েক বছর আগে প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস সংক্রান্ত একটা কোর্স করতে গিয়া চোখে পড়ছিল। যেই ক্লাসে এই ম্যাপটা পাইছিলাম, তা ছিল তুর্কির আনাতোলিয়া অঞ্চলে আসিরিয় ট্রেড কলোনি বিষয়ে। আসিরিয়রাই ঐ সময়কার আনাতোলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের নামের রেকর্ড রাখছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮ শতকের আনাতোলিয়ার ম্যাপে একটা এলাকার নাম "পুরুষাদ্দুম" দেখে চোখ আটকে গেছিল। নামটার মধ্যে কেমন যেন পুরুষোত্তমের গন্ধ আছে। আইয়ুবের কিতাবের রাম নামটা বা এই পুরুষাদ্দুম নামটার সাথে আমাদের কাছে পরিচিত রাম বা পুরুষোত্তমের মিলটা নিখাদ কাকতাল ও হোমোনিমির (মানে একইরকম বা কাছাকাছি উচ্চারণের শব্দ) কারনে হইতে পারে। তো, শিক্ষকরে জিজ্ঞাস করে অবশ্য জানতে পারি নাই যে পুরুষাদ্দুম নামটা আসলেই সংস্কৃতের কাছাকাছি ইন্দোইউরোপিয় কোন ভাষার কিনা। ইন্দোইউরপিয় ভাষা তার এক্সপার্টিজের এলাকা না। তবে তিনি কেবল বললেন যে হইলে হইতেও পারে। কেননা ততোদিনে ইন্দোইউরোপিয় ভাষাভাষী লোকেরা তুরস্কে বসতি স্থাপন করে ফেলেছে। এবং এর কয়েকশ বছরের মধ্যেই সেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে হিট্টি ও মিটান্নিদের মতো ইন্দোইউরোপিয় ভাষাভাষীদের রাজত্ব। এবং শুধু তুরষ্কেই না, ব্যাবিলনেও কাছাকাছি সময়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কাসাইট নামক ইন্দোইরানিয় জাতির রাজত্ব। ব্রোঞ্জ এজ কলাপ্সের আগে পর্যন্ত এই কাসাইটরাই ছিল ব্যাবিলনিয় সাম্রাজ্যের পতাকাবাহী।
★ হিন্দুত্ববাদের ইতিহাস
হিট্টিরাই অবশ্য খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহশ্রাব্দের সবচাইতে বিখ্যাত ইন্দোইউরোপিয় জাতি। ব্রোঞ্জ এজ কলাপ্সের আগে ভূমধ্যসাগর তীরবর্তি অঞ্চলের (প্রাচীন ইজরায়েল, ফিলিস্তিন ইত্যাদি অঞ্চল সহকারে) মালিকানা নিয়া মিশরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল হিট্টি সাম্রাজ্য। তবে, সংস্কৃত বিভিন্ন নামের কাছাকাছি নাম আপনি পাইবেন সবচাইতে বেশী মিটান্নিদের রাজত্বে। তাদের রাজাদের নাম বেশ সংস্কৃত ধরণের। এবং তাদের কিছু টেক্সটেই আমরা পাই দেবতা মিত্র, ইন্দ্র ও বরুণের নামের সবচাইতে প্রাচীন রেকর্ড। এই রেকর্ডগুলা খ্রিষ্টপূর্ব তেরোশ বছরেরও বেশী আগের। আপনি কি ঐ আমলের হিন্দুস্তানের কোন টেক্সট দেখাইতে পারবেন যেইখানে মিত্র, ইন্দ্র ও বরুণের নাম আছে? পারবেন না।
কিন্তু এই নামগুলা বেদে আছে। বেদ তবে কবে লেখা হইছে? বাস্তবে খৃষ্টপূর্ব আমলের বেদের কোন লিখিত সংস্করণ নাই। বেদের সব টেক্সট এক সময়েরও না। বেদের টেক্সটের কিছু অংশকে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহশ্রাব্দের বলে মনে করা হয় ফিলোলজিকাল কারনে। এবং, যদি আমার স্মৃতি ভুল না করে থাকে, তবে অন্যতম একটা ফিলোলজিকাল কারন হইল বরুণ, মিত্র, ইন্দ্র এই নামগুলা থাকা। যেহেতু এই নামগুলা মিটান্নির লোকেদের টেক্সটে পাওয়া যায় খৃষ্টপূর্ব ১৩০০ সালের আগে, এবং যেহেতু খৃষ্টের জন্মের হাজার দেড়েক বছর আগেই মধ্যপ্রাচ্যে ইন্দোইউরোপিয় জাতির লোকেরা প্রবেশ করেছিল, সেহেতু হিন্দুস্তানেও কাছাকাছি সময়েই সংস্কৃত ভাষার লোকেরা প্রবেশ করেছিল বলে ধারণা করা হয়।
হিন্দুস্তানের ইতিহাস বা বেদ নিয়া আমার জ্ঞান খুব কম। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে যা জানছি, তার ভিত্তিতেই উপরের কথাগুলা লিখলাম। কোন ভুল কিছু বলে থাকলে বিশেষজ্ঞরা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং ভুল শুধরে দিবেন, এই কামনা করি। কিন্তু উপরে যা বলছি, তার ভিত্তিতে আমার নিজের কিছু সন্দেহ আছে বেদের প্রাচীনত্ব বিষয়ক স্মুথ নেরেটিভটা নিয়ে।
খৃষ্ঠপূর্ব হাজার দেড়েক বছর আগের মধ্যপ্রাচ্যীয় কিছু ইন্দো ইউরোপিয় জাতির ভাষার সাথে বেদের কিছু অংশের মিল থাকায় কি আমরা বেদকে ঐ মধ্যপ্রাচ্যীয় জাতিদের আমলের বলে নিশ্চিত হইতে পারি? অথবা, বেদের ঐ প্রাচীন অংশের লেখকরা খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহশ্রাব্দে হিন্দুস্তানে প্রবেশ করেছিল, এমন নিশ্চয়তা দিতে পারি? আমার মনে হয়, পারি না। কিন্তু এই নিশ্চয়তাগুলার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে হিন্দুস্তানে সংস্কৃত ভাষা ও বেদের ইতিহাস বিষয়ক স্মুথ নেরেটিভ।
ফিলোলজির আলাপ অল্প সময়ের জন্যে ভুলে যান। যদি আমরা শ্রেফ ঐতিহাসিক রেকর্ডের উপর নির্ভর করি, তবে আমরা দেখি যে ইন্দোইউরোপিয় অথবা ইন্দোইরানিয় বিভিন্ন জাতি, তথা আর্যভাষা ভাষীদের সবচাইতে প্রাচীন দেশ হইল তুরষ্ক, অতঃপর মধ্যএশিয়া, সিরিয়া, ইরাক ও ইরান। এবং তার বহু পরে হিন্দুস্তান।
বর্তমান দুনিয়াতেও ইরানিরা হইল সেই জাতি, যারা বিশেষভাবে নিজেদের আর্য ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে স্মরণ করে। আভেস্তা আর বেদ, দুইটা টেক্সটেরই উল্লেখযোগ্য অংশ আফগানিস্তানে লিখিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। হিন্দুস্তানে সংস্কৃতভাষী লোকেরা প্রবেশ করেছিল আফগানিস্তানের (এবং হয়তো ইরানের) পথ পার হয়ে। এবং তাদের পূর্বপুরুষরা যে তুরস্কের আনাতোলিয়ায় বাস করতো না, সেই ব্যাপারেও নিশ্চিত হয়ে বলার উপায় নাই। অন্তত মধ্য এশিয়ার কোথাও যে বাস করতেন, তা তো নিশ্চিত।
তো, হিন্দুস্তানে সংস্কৃতভাষী আর্যরাও আসছিলেন ঐ তুরস্ক, মধ্য এশিয়া, ইরান, আফগানিস্তানের পথ পার হয়েই। এবং ইসলামের আবির্ভাবের আগে বহু ইন্দোইউরোপিয় জাতিই হিন্দুস্তানে বিভিন্ন সময়ে হিজরত করেছে। কিন্তু হিন্দুস্তানে বেদ ও সংস্কৃত ভাষার প্রাচীনতার স্মুথ নেরেটিভটার উপর ভর করে হিন্দুত্ববাদীরা ইতিহাস+মিথ্যাচারের ব্যবসা ফেদেছে। অনেকেতো হিন্দুস্তানকেই আর্য জাতির উৎপত্তিস্থল বলে প্রচার করেন। এবং সনাতন ধর্ম নামক একটি প্রাচীন ধর্মের অনুসারী হওয়ার দাবি তোলেন এনারা, যেই ধর্ম নাকি খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহশ্রাব্দ থেকেই একটা সমসত্ত্ব রূপ নিয়া সরলরৈখিক ইতিহাসের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আমাদের সময়ে এসে পৌছেছে।
হিন্দুত্ববাদীরা প্রচার করে যে তারা হিন্দুস্তানের আদী ও আসল সনাতন ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুসারী। সুতরাং, তারাই হিন্দুস্তানের আদী ও দেশী জাতি। আর আফগানিস্তান থেকে আসা ঘুরি এবং খলজিরা হইলেন তুর্কি আর ইরানি।
তো, এইসব ইতিহাস নিয়া বাংলাদেশের মানুষের বহু আলাপ আলোচনা ও তর্ক করা উচিৎ। নাইলে - নেরেটিভের খেলা, বুঝবি ক্ষেপা, কেমন করে?
★ হিন্দুত্ববাদের ইতিহাস ★ Collected
No comments:
Post a Comment
Thank You So much for Your Valuable feedback